BDNewsWORLD

মানবিক করিডোর কি |Humanitarian Corridor

মানবিক করিডোর (Humanitarian Corridor) বলতে এমন একটি নিরাপদ পথ বা এলাকা বোঝায় যা যুদ্ধ বা সহিংসতার মধ্যে আটকে পড়া অসামরিক জনগণ, আহত ব্যক্তি, অথবা ত্রাণ সহায়তা প্রদানকারীদের নিরাপদ চলাচলের জন্য নির্ধারিত হয়।মানবিক করিডোর কি এটি সাধারণত দুই বা ততোধিক বিরোধপূর্ণ পক্ষের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে স্থাপন করা ।

মানবিক করিডোরের ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই কার্যকরভাবে মানবিক করিডোরের ধারণাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়া ও রুয়ান্ডা সংকটে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক মনোযোগ পায়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এই ধরনের করিডোর পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

মানবিক করিডোর
মানবিক করিডোর

মানবিক করিডোর কিভাবে কাজ করে?

সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থা,মানবিক করিডোর গঠনের জন্য যেমন জাতিসংঘ, যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট সময় ও অঞ্চল নির্ধারণ করে। এরপর ঐ এলাকায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই সময়ে অসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয় বা ত্রাণ পৌঁছানো হয়। এটির কার্যকারিতা নির্ভর করে সব পক্ষের সম্মতিতে ও আস্থায়।

মানবিক করিডোরের প্রয়োজনীয়তা

মানবিক করিডোর সাধারণত তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে যখন:

  • নিরীহ মানুষ গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়।
  • হাসপাতাল ও খাদ্য সরবরাহের সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়।
  • শিশু ও বৃদ্ধরা সংকটময় এলাকায় আটকে পড়ে।
  • আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এই করিডোরের মাধ্যমে মানুষ কেবল জীবন রক্ষা করে না, বরং একটি সম্মানজনক নিরাপত্তাও লাভ করে।

বাস্তব জীবনে মানবিক করিডোরের প্রয়োগ

1.মানবিক করিডোর বাংলাদেশ

বাংলাদেশে সরাসরি যুদ্ধকালীন মানবিক করিডোর না থাকলেও, রোহিঙ্গা সংকটে সীমান্ত এলাকায় একটি মানবিক সহায়তা রুট তৈরি করা হয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার ও উখিয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য নিরাপদ ও সংগঠিত রুট তৈরি করে।

2.গাজা মানবিক করিডোর

গাজা অঞ্চলে ইসরায়েল ও হামাসের সংঘাতের সময় মানবিক করিডোর তৈরি হয় আন্তর্জাতিক চাপে। এসব করিডোর দিয়ে ত্রাণসামগ্রী, পানি, ওষুধ এবং খাবার প্রবেশ করে এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য বাইরে নেওয়া হয়। তবে অনেক সময় এসব করিডোরও হামলার শিকার হয়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

3.ইউক্রেন যুদ্ধ করিডোর

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে মারিউপোল, বুচা ও খারকিভ অঞ্চলে বহুবার মানবিক করিডোর চালুর চেষ্টা করা হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় পক্ষেই একে অপরের ওপর এই করিডোর ব্যর্থ হওয়ার দায় চাপায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও অনেক করিডোর ছিল অনিরাপদ।

4.রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা রুট

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে স্থাপিত মানবিক সহায়তা রুট আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়। জাতিসংঘ, UNHCR, WFP, ও বিভিন্ন এনজিও এই রুট ব্যবহার করে খাদ্য, ওষুধ, আশ্রয় ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে। টেকনাফ থেকে কুতুপালং পর্যন্ত এই রুটে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন কাজ করে।

মানবিক করিডোর উদাহরণ

  • সিরিয়া: আলেপ্পো ও ইদলিবে মানবিক করিডোর চালু হয়েছিল।
  • ইথিওপিয়া: টাইগ্রে অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য করিডোর খোলা হয়।
  • ইয়েমেন: হোদেইদা বন্দরের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহের করিডোর তৈরি হয়।

এই উদাহরণগুলো দেখায় যে মানবিক করিডোর যুদ্ধক্ষেত্রে মানবতা রক্ষার একটি কার্যকর উপায়।

বাংলাদেশে মানবিক করিডোরের প্রেক্ষাপট

humanitarian corridor in bangladesh
humanitarian corridor in bangladesh

বাংলাদেশ সরাসরি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ না হলেও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট চলাকালে সীমান্তবর্তী এলাকায় এক ধরনের মানবিক করিডোর কার্যকর হয়। লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় গ্রহণ করে এবং জাতিসংঘের সহায়তায় খাদ্য ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া হয়।

মানবিক করিডোর স্থাপনের বাধা

মানবিক করিডোর স্থাপন একটি জটিল কাজ। কারণ:

  • যুদ্ধরত পক্ষদের মধ্যে অবিশ্বাস
  • গোলাবর্ষণের ঝুঁকি
  • করিডোরে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের ভয়
  • যথাযথ সমন্বয়ের অভাব

এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমাধান এবং সর্বজনগ্রাহ্য নীতিমালা

উপসংহার

মানবিক করিডোর হচ্ছে সংকটময় মুহূর্তে মানবতার এক অপরিহার্য প্রতীক। এটি শুধু জীবন বাঁচায় না, বরং বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয়—অন্তত সংকটের সময় আমরা মানুষ হয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশ ও সংস্থার উচিত মানবিক করিডোরকে একটি সংগঠিত ও নিয়মিত ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা, যেন কোনো মানুষ কেবল যুদ্ধের কারণে নিজের প্রাণ হারাতে না হয়।


‍📌 FAQ (প্রশ্নোত্তর)

১. মানবিক করিডোর কেন তৈরি করা হয়?

উত্তর: মানবিক করিডোর তৈরি করা হয় যেন যুদ্ধ বা দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় আটকে পড়া সাধারণ মানুষ নিরাপদে বের হয়ে আসতে পারে।

এটি মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একটি নির্দিষ্ট ও নিরাপদ পথ হিসেবে কাজ করে।


২. মানবিক করিডোর কি সব সময় সফল হয়?

উত্তর: না, সব সময় নয়। অনেক সময় নিরাপত্তা ঘাটতি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসহীনতার কারণে মানবিক করিডোর ব্যর্থ হয়।

তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকলে এর কার্যকারিতা অনেক বেড়ে যায়।


৩. মানবিক করিডোর কি কেবল যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়?

উত্তর: সাধারণত যুদ্ধকালেই মানবিক করিডোর বেশি দেখা যায়, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা গণ-অস্থিরতার সময়ও এটি ব্যবহার করা হতে পারে, যদি পরিস্থিতি জনসাধারণের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।


৪. কে মানবিক করিডোর পরিচালনা করে?

উত্তর: সাধারণত জাতিসংঘ, রেড ক্রস বা আন্তর্জাতিক রেসকিউ সংস্থা করিডোরের পরিকল্পনা ও তদারকি করে। স্থানীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে এই পথ পরিচালিত হয়।


৫. মানবিক করিডোর কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করে?

উত্তর: মানবিক করিডোরের মাধ্যমে মানুষ সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে নিরাপদে বের হতে পারে, যার ফলে তারা গুলিবিদ্ধ বা বোমা হামলার শিকার না হয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়।এছাড়া, খাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানিও এই পথে পৌঁছানো যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *